জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গণপিটুনিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লার মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় সারাদেশ। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ধোঁয়াশা।
১৫ জুলাই উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া শামীম মোল্লার যেখানে ক্যাম্পাসের ত্রিসীমানায় ঘেঁষার কথা নয়, সেই ক্যাম্পাসেই গণপিটুনিতে তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। মাদক ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুর পেছনে মাদকের টাকার লেনদেন প্রভাবক ভূমিকা পালন করেছে কি না সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যুর ঘটনায় পেছন থেকে ঠিক কারা লাভবান হলো সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, শামীম মোল্লার মাদক ব্যবসার যারা সহযোগী ছিলো, ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর তারা সকলেই গা-ঢাকা দেয়। ফলশ্রুতিতে একা হয়ে পড়েন শামীম মোল্লা। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি। শামীমের ব্যবসায়ের অংশীদাররাই তাকে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য কৌশলে প্রান্তিকে নিয়ে আসে। সহযোগীদের অনুপস্থিতিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পাওনা টাকা আনতে ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন তিনি। এসময় প্রান্তিক থেকে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের কর্মীদের এ তথ্য গোপনে জানিয়ে দেয় একটি পক্ষ।
প্রান্তিকের দোকানদার জনি ও আবদুল মান্নান বলেন, প্রান্তিক এলাকায় এসে অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে আচার ও ফুচকা খান তিনি। পরে প্রান্তিক গেটের শেষ মাথায় আব্বাসের সেলুনে গিয়ে বসেন তিনি। সেখানে তাকে বসে থাকতে দেখে কেউ একজন সেই খবরটি ক্যাম্পাসের ভেতরে জানিয়ে দেয়। মূলত শামীম মোল্লাকে ‘মাইনাস করে’ এলাকায় মাদক ব্যবসার দখল নিতে ছাত্রদলের একটি গ্রুপ এখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা গেছে৷
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের পতনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকার মাদক সিন্ডিকেটে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্যে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি সোহেল রানা। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি সংগঠনের শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সোহেল রানাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এছাড়া শামীম মোল্লাকে মারধরের পর জাবির মীর মশাররফ হলে ছাত্রদল কর্মীদের মিষ্টি বিতরণের ঘটনা ঘটেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অবশ্য, শামীম মোল্লা ওরফে ‘শ্যুটার শামীমে’র অপরাধের ফিরিস্তিও বেশ লম্বা। মাদক ব্যবসায় স্থানীয় এলাকায় এক ত্রাসের নাম ছিল শামীম। তার ভয়ে তটস্থ থাকতো সকলে।
২০২১ সালে তার মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলায় জাহাঙ্গীরনগর স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষককে গুলি করেন শামীম। তবে গুলিটি ওই শিক্ষককে না লেগে আবুল হাসান (৪০) নামে তারই সহযোগীর গায়ে লাগে। গুলিতে আহত সে আবুল মাদক চোরাকারবার চক্রের সক্রিয় সদস্য। সে আশুলিয়ার গোকুলনগর এলাকার মৃত বাদশা মিয়ার ছেলে।
এ ঘটনায় সেই স্কুল শিক্ষক মনসুর আলী বাদী হয়ে তার নামে একটি মামলা দায়ের করেন। এর কিছুদিন পর এক ব্যবসায়ী পরিবারের মা ও সন্তানকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনাও এলাকায় বেশ আলোচিত। এ ঘটনায়ও তৎকালীন সময়ে পৃথক একটি মামলা হয়েছিল।
পানধোয়া এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর আগে তার প্রতিবেশী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর ওপর চড়াও হয়েছিলেন শামীম। হাবিবুল্লাহ বর্তমানে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) ডেপুটেশনে আছেন। এতেই তারা থেমে থাকেনি। এক বছর আগে শামীমের নেতৃত্বে চক্রটি তাকেও মারতে চেয়েছিল।
জানা যায়, মাদক সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িত থাকা ছাড়াও আরও একাধিক অভিযোগ রয়েছে শামীম মোল্লার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে রয়েছে, পোষ্য কোটায় ভর্তি হলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হলে থাকা, অবৈধভাবে হলে থাকলেও হলের ছাদে জার্মান শেপার্ড পোষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেট কারে চলাচল করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের হুমকি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর ও বিভিন্ন সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করার মত অভিযোগ ।